1. admin@banglabahon.com : Md Sohel Reza :
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা দেখিয়ে দিল করোনা
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:০০ অপরাহ্ন

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা দেখিয়ে দিল করোনা

ডেড লাইন
  • প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের করোনা হয়েছে কেবল এই ধারণার কারণে একের পর এক হাসপাতাল তার চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানিয়েছে। এইরকম ঘটনা এটিই প্রম না। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এইরকম সংবাদ আরও জেনেছি। এর অনেক কারণ আছে। প্রম দিকে করোনাসংক্রান্ত সব কিছু সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি দুর্নিবার প্রয়াস লক্ষ করেছি। তাদের একটি ভয়, যদি আমাদের সব হাসপাতাল বিশেষ করে প্রাইভেট হাসপাতালের হাতে টেস্ট ও অন্যান্য সুযোগ দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে। করোনা টেস্ট কেবল মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইইডিসিআরই করতে পারবে। অন্য হাসপাতালে করোনা লক্ষণ নিয়ে কেউ গেলে ডাক্তাররা করোনা হয়েছে কিনা শনাক্ত করতে পারছিল না। কারণ তাদের সেই সুবিধা অর্জন করতে দেওয়া হয়নি। ফলে কারও করোনার লক্ষণ আছে এই কথাটা বলতেও ডাক্তাররা সাহস পায়নি। কেন জানি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের মাঝে এক ধরনের ফিসফাস আর ভয় ভয় ভাব বিরাজ করতে দেখেছি, যা এখন অনেকটা কেটে গেছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দিন যতই গড়াতে থাকে পরিস্থিতি একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া শুরু হয়। তখন ডাক্তাররাও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এখানে বলে রাখা ভালো, ইতালিতে করোনার ভয়াবহতার একটি অন্যতম কারণ হলো প্রম দিকে ডাক্তাররা করোনা রোগীকে সাধারণ নিউমোনিয়া ভেবে চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীর কাছ থেকে ডাক্তাররাও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রম দিকে এই ডাক্তাররাই সুপার স্প্রেডার হয়ে যায়। তাই ডাক্তারদের সুরক্ষা সর্বাগ্রে দরকার ছিল। আমরা সৌভাগ্যবান যে করোনার প্রস্তুতির জন্য আমরা অনেক সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা সেই সৌভাগ্যকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল যথেষ্ট পরিমাণ টেস্ট কিট ও ডাক্তারদের জন্য পিপিইর ব্যবস্থা করা। তারা সেটা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ছাড়া ডাক্তাররা কেন রোগী দেখবে? মানবিকতার খাতিরে যদি দেখেও তখন সেতো সুপার স্প্রেডার হয়ে আরও ক্ষতি করবে। এইসব মিলিয়ে আমাদের হাসপাতালগুলো করোনা রোগী সন্দেহ হলেই তাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

ইতালিতে ৮৭ জন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। কই একটি হাসপাতালও তো একজন রোগীকেও ফিরিয়ে দেয়নি। একজন ডাক্তারও তো চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানাননি। তাদের কি নিজের ও পরিবারের প্রতি মায়া নেই? আমাদের চেয়ে বেশি ছাড়া একবিন্দুও কম নেই। তাহলে আমাদের এখানে সমস্যা কোথায়? আসলে ডাক্তার তো এই সমাজেরই একটি অংশ। অন্য পেশায় যেই অমানবিকতা দেখি তার প্রতিফলন তো এখানেও পড়বে। এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকরা ক্লাসে না পড়িয়ে অথবা কম পড়িয়ে প্রাইভেট কিংবা কোচিং সেন্টারে পড়াবে অথবা পার্টটাইম পড়াবে। রাজনৈতিক নেতারা গরিবদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে ছবি তুলে সেই ত্রাণ আবার ফিরিয়ে নেবে। বিভিনড়ব জায়গায় সরকারি দলের নেতারা ত্রাণের চাল চুরি করবে অথবা ভবিষ্যতে লাভের আশায় মজুদ করবে। এমপিরা দুর্নীতি করবে আর আমলারা ঘুষ খেয়ে দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় বানাবে। ব্যবসায়ীরা ভেজাল মেশাবে, ইঞ্জিনিয়াররা ঘুষ খাবে। এইরকম একটি সমাজে কীভাবে আশা করবেন যে ডাক্তাররা পূতপবিত্র ফেরেশতা হবে।

পৃথিবীর আরেকটি দেশ দেখান তো যেখানে ডাক্তারি পাস করার পর বিসিএস দিয়ে অ্যাডমিন ক্যাডারে গিয়ে কেরানিগিরি করে? পৃথিবীর এমন আরেকটি দেশ দেখান তো যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর বিসিএস দিয়ে অ্যাডমিন ক্যাডারে গিয়ে কেরানিগিরি করে? বিশেষ করে ডাক্তার হয়ে অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়া একটা ক্রাইম। কারণ বাংলাদেশের পাবলিক মেডিকেল কলেজে যদি কেউ পড়ে থাকে তাহলে তার পেছনে রাষ্ট্রের একটি বিরাট অংকের ট্যাক্সের টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে সেটা কেরানি হওয়ার জন্য না। কিন্তু কেন এটি হচ্ছে আমাদের সেই শানে নুজুলও বুঝতে হবে। যখন কোনো এক ক্যাডার আমলা বলে “আমার অধীনে ‘এতজন’ ডাক্তার আছে। আমি না থাকলে এদের বেতন হবে না” তখনই সব পরিষ্কার হয়ে যায় সমস্যাটা কোথায়।

আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষায় যারা আসে তাদের একটা বড় অংশ আসলে আসে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে। বাংলাদেশের প্রায় সব বাবা-মায়েরাই সন্তানকে নিয়ে স্বপড়ব দেখেন যে তাদের সন্তান একদিন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে কেন ডাক্তারি পাস করে ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত না হয়ে আমলা হতে চায়? ভুটানের প্রধানমন্ত্রী একজন ডাক্তার এবং তিনি বাংলাদেশ থেকেই ডাক্তারি পাস করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহের ছুটির দিনে পুরোদস্তুর ডাক্তারি করেন।

ডাক্তার হয়ে পরে আমলা হওয়া যে রাষ্ট্রের জন্য কত বড় অপচয় সেটা যারা ভাবার তারা ভাবে না কিংবা ভাবতে অক্ষম। কেন ভাবেনি? কারণ এই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খারাপ হলে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তো সামান্য কিছু হলেই সিঙ্গাপুর লন্ডন দৌড়ায়। এইজন্য তারা স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ০.৮% বরাদ্দ দেয়। এই জন্য ডাক্তার আর নার্সরা অবহেলিত। ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণ করেন অ্যাডমিন ক্যাডাররা, যাদের অনেকে হয়তো এক সময় ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলেন। হওয়ার কথা ছিল উল্টো। অ্যাডমিন ক্যাডারদের হওয়ার কথা ছিল ডাক্তারদের অর্থাৎ চিকিৎসা খাতের সার্ভিস প্রোভাইডার।

কেন এমন হলো? কারণ বাংলাদেশে এখন যেন একটিই ভিআইপি চাকরি, সেটা হলো বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার। এই পেশার ক্ষমতা এবং জৌলুশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরা অন্য কোনো পেশাকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। অথচ সারা পৃথিবীতে অন্য পেশা যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষকদের জন্য আমলারা নিরলস কাজ করে যান। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য হলো একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এই জায়গাটাকে আমরা সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছি। যার জন্য ডাক্তাররা হয় বিদেশ চলে যান, না হয় অ্যাডমিন ক্যাডারে যেতে চান। যারা পেশাটাকে একটু বেশি ভালোবাসেন তারা থেকে যান। অনেকেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি চাকরি করতে চান না। একই কথা খাটে শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও।

ডাক্তারি কত সম্মানের এবং গুরুত্বপূর্ণ পেশা, আশা করি এইবার আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমি যখন পিএইচডি করছিলাম তখন আমি একটি হাসপাতালের নার্স হোস্টেলে ছিলাম এক বছর। আমি দেখেছি লন্ডনে নার্সদের কী মূল্য। আমি একসঙ্গে একই রানড়বাঘরে নার্সদের সঙ্গে রাণ্ণা করে খেয়েছি। আমি তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। তারা কী সুন্দর একসঙ্গে নারী ও পুরুষ নার্স মিলে থাকেন। এরা এত ভালো এবং সমাজও তাদের অনেক সম্মান দেয়। ডাক্তাররা আরও বেশি দেন। অনেক ডাক্তার আছেন যারা নার্সদের কাছ থেকে শেখেন। আমার পিএইচডি সুপারভাইজরের স্ত্রী একজন নার্স। আর আমাদের দেশে নার্সরা কাজের বুয়ার মতো আচরণ পান। এই দেশে স্বাস্থ্যসেবা কোথা থেকে পাবেন?

ইতালির ডাক্তার আর নার্সরা সহজে রোগী হাসপাতালে নেন না কারণ রোগীর সংখ্যা এবং হাসপাতালের বেডের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবে সেখানে প্রত্যেক রোগীর বাসাই হয়ে যাচ্ছে একেকটি হাসপাতাল। ওখানে কারও মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে নার্স গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে টেস্ট করেন এবং রোগীকে তার নিজের বাসায় থাকতে বলা হয়। টেস্টে পজিটিভ হলে তার বাসাই হয়ে যায় হাসপাতালের অংশ। ডাক্তাররা যাচ্ছেন এবং নার্সরা সার্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছেন। কেবল ‘আইসিইউ’ বা ‘ভেন্টিলেটর’ প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার স্ত্রীর স্কুলের এক বান্ধবী এখন ইতালির এক হাসপাতালের নার্স। গতকাল তার সেই নার্স বন্ধুটি এক বৃদ্ধ নারী করোনা রোগী কীভাবে মারা গেল সেটা জানালেন। সেই বৃদ্ধার বয়স ৮৭ বছর। তার অবস্থা দেখে নার্সের মনে হয়েছিল সে হয়তো বাঁচবে না। ওদিকে করোনায় আক্রান্ত বলে রোগীর নিকটাত্মীয়রাও তার কাছে আসতে পারেননি। রোগী যেন মারা যাওয়ার সময়ও একাকিত্বে না ভোগেন সেজন্য ওই নার্স সার্বক্ষণিক ওই রোগীর পাশে ছিলেন। ডাক্তার আর নার্স এমনই হয়।

আশা করি করোনাভাইরাস আমাদের বোধকে চিরদিনের জন্য জাগিয়ে দেবে। আমরা বুঝতে শিখব যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অবহেলা করলে কোনো দিনই একটি দেশ সত্যিকারের ‘উনড়বত দেশ’ হতে পারে না। পুরো সমাজকে নিয়ে এগুতে না পারলে মানুষও সত্যিকারের মানবিক ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না। একটি দেশের কেবল একটি পেশার মানুষ মানবিক হবেন এটাও কখনো হয় না। গত বছর ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে গিয়ে ২৮ জন ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু আমরা সমাজে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সেই আত্মত্যাগের কথা, তাদের ইতিবাচক ভূমিকার কথা কখনোই সামনে নিয়ে আসতে পারিনি। এখন এই করোনার মহাদুর্যোগে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদের নেতৃত্বেই আমাদের এই বাঁচা-মরার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। লেখক অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় khassan@du.ac.bd

সূত্র: দেশ রুপান্তর

শেয়ার করতে চাইলে...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ...
© বাংলা বাহন সকল অধিকার সংরক্ষিত ২০১৯-২০২৪।
ডিজাইন ও আইটি সাপোর্ট: বাংলা বাহন
error: Content is protected !!