ইদানিং খুব কমন একটা বিষয় হল আত্মহত্যা। প্রায় প্রতিদিনই টিভি চ্যানেল খুললে বা ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যায় কেউ না কেউ আত্মহত্যা করেছে! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- সেখানে বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের সংখ্যাই বেশি! আশ্চর্য কেন বলেছি? তা বলছি-
মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যত বড় বা বয়স্ক হবে, ততো তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে। তবে, দেখা যায় মানুষকে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বেশি হতে হয়। সেই তিক্ততা একটা সময় বিষাদে পরিণত হয়…যা মানুষটাকে জিন্দা লাশ বানিয়ে রাখে। তাই তিক্ততা বা বিষাদের পরিমাণ পরিমাপ করলে, একজন বয়স্ক ব্যক্তির আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার কথা। কারণ, আশাহত একটা মানুষের জীবনে আর কোন চাওয়া পাওয়া থাকে না।
কিন্তু তরুণরা আত্মহত্যার দিকে বেশি ঝুঁকছে কেন?
এই কেনোর উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। মাত্র কয়েকটা কারণ বলছি-
আমার কথাই বলি, আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু আমার মাঝেও যে এটা কখনো দেখা দেয়নি তা না। হয়তোবা একেক সময়ের ব্যাখ্যা একেক রকম ছিলো।
মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে- গলায় ফাঁস লাগাই। আবার মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে- হাতের উপর ব্লেড রেখে জাস্ট একটা টান দিয়ে দেই। কখনো কখনো মনে হয়েছে- বিষ খেয়ে মৃত্যু অনেক শান্তির। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে- ১০ তলা ভবনের উপর থেকে লাফ দিয়ে পরলে হাড় ভাঙ্গার যে শব্দটা হবে বা মাথার খুলি যে চটাস করে ফেটে যাবে, সেটাও একটা চমৎকার ব্যাপার হবে।
এখন ভাবতে পারেন- এসব মনে হওয়ার কারণ কি?
কারণ যে আসলে কি? সেটি আমরা সঠিকভাবে কেউই জানি না। একটা সময় মনে হয়েছে, সব মানুষের ভিড়েও আমি একা। আমার সাথে কথা বলা বা কথা শোনার মত কেউ নেই। চরম একাকিত্ব যাকে বলে! আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের, প্রচুর হাসিখুশি। কিন্তু জানেন তো, হাসিখুশি মানুষগুলি নিজের সমস্যার কথা অন্যকে জানাতে পারে না কিংবা বোঝাতে পারে না। আর আত্মহত্যা করা ছেলে বা মেয়েটার খোঁজ নিয়ে দেখেন, তার বাবা মা একই কথা বলবে। আমার মেয়ে/ছেলে তো খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিলো, সে কিভাবে এটা করলো? হাজারো মানুষের ভিড়ে নিজেকে একা বলে আবিষ্কার করেছি। নিজের ভাল লাগা, মন্দ লাগা অন্যকে জানাতে চেয়েছি, কিন্তু মনে হয়েছে শোনার মত আসলে কেউই নেই।
একটা ব্যাপার কি জানেন? শতভাগ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৫% পরিবার সন্তানকে বুঝতে পারে বা বোঝার চেষ্টা করে। বাকি ৯৫% বুঝে না তাদের কি করা উচিত?
একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করে। তখন প্রচুর জ্ঞানী লোকের উদয় হয়। তখন তারা গম্ভীর গলায় বলে উঠবে, আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা কোন সমাধান নয়। কিন্তু আপনি তার কাছে সমাধান জিজ্ঞাসা করুন- আমি বাজি ধরতে পারি। সে আপনাকে সঠিকভাবে বলতে পারবে না যে সমাধানটা আসলে কি? কারণ সমাধানের বিষয়ে আমরা অনেক বেশি উদাসীন।
এগুলোই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই যে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েগুলো চরম ডিপ্রেশনে ভোগে এর কারণ কি?
প্রতিটা প্রবলেমই শুরু হয় পরিবার থেকে। সেটা প্রেম বলেন, পরকীয়া বলেন বা নির্যাতনের কথাই বলেন!
আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পাবেন, আত্মহত্যা করা বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরই ফ্যামিলি প্রবলেম।
প্রতিটা ফ্যামিলি যদি তার সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদের সময় দেয়, তাহলে আমার মনে হয় আত্মহত্যার মত ঘটনা কমে যাবে। কারণ আপনার সন্তানটি যদি চরম হতাশায় নিমজ্জিত থাকে। সেটি আপনার জানতে হলে আগে আপনাকে তার কাছাকাছি যেতে হবে। যেটা শাসন করে সম্ভব নয়।
যার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহরুপে প্রকাশ পেয়েছে। আপনারা তাদের সাথে কথা বলুন, জানার চেষ্টা করুন, অভয় দিন, সাহস দিন, হাসুন, প্রচুর হাসুন, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান, সময় দিন। সাপোর্ট তার মনে শান্তি এনে দিবে, সে হতাশায় নিমজ্জিত হবে না। মানুষ যখন বয়ঃসন্ধিতে থাকে, তখন তার আবেগ হয় আকাশ ছোঁয়া, হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় তখন। ভাল মন্দের হিসেব তারা করতে জানে না। অল্পতেই অভিমানী হয়। আবার অল্পতেই ভেঙে পরে। তাই সাপোর্ট দিন, পাশে থাকার চেষ্টা করুন। প্রতিটা মানুষেরই একজন Imaginary friend বা কাল্পনিক বন্ধু থাকে। কিন্তু কাল্পনিক বন্ধুটি যে সব সময় তাকে ভাল বা উপকারি পরামর্শ দিবে ঠিক তা নয়। সে মানুষেরই তৈরিকৃত একটি চরিত্র, মানে একজন মানুষের আরেকটি সত্ত্বা সেটা তো তারই তৈরি, মানে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিটিরই, সেটা তাকে ভাল পরামর্শ দিবে সেটা ভাবাও বোকামি। কারণ, একজন হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তি কখনো অন্যজনকে হতাশামুক্ত করতে পারে না। তাই তার কাল্পনিক বন্ধুটিও তাকে টেনে তুলতে পারে না।ফলাফল, যখন টেনে তুলতে ব্যর্থ হয়, সে আত্মহত্যা বা কোন অপরাধ করার পরামর্শ দেয়াটা স্বাভাবিক! মানুষের মনে কথা জমতে জমতে যখন পাহাড়সম হয়। তখন মানুষ যার প্রয়োজনবোধ করে তা হচ্ছে-‘কথাবন্ধু।’ যার কাছে সমস্ত কিছু বলা যায়। বাবা মা, স্বামী স্ত্রী ইচ্ছে করলেই ‘কথাবন্ধু’ হতে পারে। তাই আপনারা প্লিজ ‘কথাবন্ধু’ হয়ে দেখুন- সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
জীবন অনেক সুন্দর, আমরা উভয়ে চাইলেই পারি, আরও সুন্দর করতে!!!
তাই আপনজনকে বোঝার চেষ্টা করুন।
ভাল থাকুক আপন ও ভালবাসার মানুষগুলি।
লেখক:
শারমিন সুলতানা রিমি
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা