দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ থেকে অবলোপন বা মূল হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। মামলার বিপরীতে আটকে আছে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
শনিবার ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট কেন, সমাধান কীভাবে’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এসব কথা বলেছেন।
ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এই ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক জাহেদ উর রহমান।
আলোচক ছিলেন সিটি ব্যাংক এনএ’র বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাহী মামুন রশীদ, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন, জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক জিয়া হাসান।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম আরও বলেন, তিন মাস পরপর বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করে তা সঠিক নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্ধেকের মতো বছরের পর বছর ধরে মামলায় ঝুলে আছে। অর্থাৎ যত দিন মামলাগুলো চলবে, তত দিন খেলাপি হিসাবে এগুলোকে গণ্য করা হবে না। কিন্তু এগুলো খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করার মতো। ব্যাংকগুলো খেলাপি করলেও আদালতে নির্দেশনার কারণে আরও ঋণ খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হিসাবে দেখানো হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এসব যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি।
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু রয়েছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। লুটপাট করে নেওয়া ঋণ আর আদায় হয় না। ফলে ব্যাংক এগুলোকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আমার ২০১০ সালে ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে।
গত ৩০ বছর ধরে আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারের একটি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে ঋণখেলাপিদের প্রশ্রয় ও নানা সুবিধা দেওয়া। এর ফলে ঋণখেলাপিরা সুবিধা পেয়ে ঋণ নবায়ন করছেন। বারবার এমন সুযোগ দেওয়ার পর খেলাপিদের ঋণ শোধের প্রবণতা কমে গেছে। ২০১৯ সাল থেকে খেলাপিদের ঋণ নবায়নের সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা আরও বাড়ানো হয়েছে। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়ার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিছু দিন আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের আরও সুবিধা বাড়ানো।
ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের এক কোটির বেশি মানুষ প্রবাসে কর্মরত রয়েছে। তারা ব্যাংকিং চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে যে অর্থ পাঠান, তা ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা পড়ে। এ আমানত নানাভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। এখন যারা ঋণখেলাপি তারা বিশেষ কোনো বিপদের কারণে খেলাপি হননি। অনেকটা বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার আরও একটি বড় কারণ লুটপাটের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই প্রভৃতি দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ড. মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ডলারের সংকট হওয়ায় টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ। এ কারণে মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। সারা দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে খারাপ অবস্থা, এর পেছনে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণও দায়ী। লুটপাটের কারণে টাকা পাচার হয়েছে। এর খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে বেশির ভাগ অর্থের জোগানদাতা সাধারণত আমানতকারীরা। তার পরও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের পারিবারিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। কোনো সভ্য দেশের সরকার তা মেনে নিতে পারে না।