করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে বছরব্যাপী ছাড় চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়ের মেয়াদ আরো বাড়িয়ে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত করার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শিগগিরই এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানোর চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিস্তি পরিশোধে আরো সময় চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্প-বাণিজ্যে করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাব ছিল মারাত্মক। এখনো মহামারীর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো পথও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধের সময় কত দিন পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন তাও নির্ভর করছে করোনার গতিপ্রকৃতির ওপর। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আগামী জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে প্রথম দফায় গত এপ্রিলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দফায় জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণী মানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় এ মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং তৃতীয় দফায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সে হিসাবে আর ক’দিন পরই এ সুযোগ শেষ হচ্ছে। যদিও তার আগে ছাড়ের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে কিছু ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্য, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে জানুয়ারি থেকে ঋণ শ্রেণীকরণ শুরু হলে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ব্যাংকের জন্যও বিপর্যয় নেমে আসবে।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা একই সঙ্গে বড় ব্যবসায়ীও। নিজ ব্যাংকের পাশাপাশি অন্য ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ নিয়েছেন পরিচালকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের ঋণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। এ অবস্থায় জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধ্যকতা চালু হলে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে পারেন। এজন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ পরিচালকই চাচ্ছেন ঋণের কিস্তি আগামী জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হোক।
ব্যাংকঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত পেছানো দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। এক্সিম ব্যাংকের এ চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যবসায়ীরা বাঁচলে ব্যাংকও বাঁচবে। করোনার প্রথম আঘাতের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় আঘাত এসেছে। ইউরোপের অনেক দেশে দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন শুরু হয়েছে। ফলে তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাতের অনেক আদেশ আবারো বাতিল বা পিছিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের অবস্থাও ভালো নয়। এ অবস্থায় অনেকের পক্ষেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। জানুয়ারি থেকে খেলাপি ঋণ গণনার সময় শুরু হলে বহু ব্যবসায়ীর ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ব্যাংকও বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে।
তবে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা আরো বাড়ানো হলে সেটি আত্মঘাতী হবে বলে মনে করছেন কিছু ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপক। তারা বলছেন, এরই মধ্যে তিন দফায় ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। বছরব্যাপী ছাড়ের পর আরো ছাড় দিলে বিপদ হয়তো কিছুদিন পিছিয়ে যাবে, কিন্তু তা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে। বড় গ্রাহকরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন না। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়া ঋণগ্রহীতাদের অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে।
ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার মেয়াদ বাড়ানো হলেও তা যেন ঢালাওভাবে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অনেকেই দাবি করছেন ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার সময়সীমা বাড়ানো হোক। এ দাবি পূরণ করা হলে ব্যাংকার হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য আমি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকব। কিন্তু এর শেষ কোথায় সেটি আমাদের জানা নেই। গ্রাহকরা টাকা না দিলে ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। আবার টাকা আদায় না হলে ব্যাংকের পক্ষে নতুন বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীর ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতার মেয়াদ না বাড়িয়ে খাতভিত্তিক ছাড় দেয়া যায় কিনা, সেটি দেখা দরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের ভিত্তিতে খেলাপি করার ক্ষমতা দেয়া হলে অন্তত আরো কিছু টাকা আদায় হতো।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে ছিল টালমাটাল পরিস্থিতি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছাড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালে রেকর্ড ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে বছর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়ের কারণে চলতি বছরে ব্যাংকের কোনো ঋণ খেলাপি হওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও সেপ্টেম্বর শেষে ৯৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল খেলাপি ঋণ। এর বাইরে ২০১৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। এ ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ যুক্ত হলে ব্যাংকিং খাতের বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা ফিরে এলে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংকাররা।
কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা শিথিল করায় চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে ব্যাংকগুলো শিল্পের মেয়াদি ঋণ থেকে আদায় করেছে ১০ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে ব্যাংকগুলো এ খাত থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ আদায় করতে পেরেছিল। ঋণ আদায়ে প্রায় একই পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর অন্যান্য ঋণেও। সিএসএমই, কৃষিসহ ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের কিস্তি আদায়ও অনেক কমে এসেছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লো কমছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বছরব্যাপী ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন ছাড়ের সময়সীমা আরো বাড়ানোর জন্য দাবি আসছে। তবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হবে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মঙ্গলজনক সিদ্ধান্তই নেবে।
সূত্র: বণিক বার্তা