বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির সাজা হবে কি না তা জানা যাবে বুধবার।
বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামানের এ মামলার রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে বুধবার। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এ মামলায় সাক্ষী থেকে আসামি বনে যান নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নি। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার দেখায় তাকে। এরপর হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। বিচারিক কার্যক্রম শেষে জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলামের জিম্মায় রয়েছেন মিন্নি।
রায় প্রকাশের পর কী ঘটবে মিন্নির ভাগ্যে তা নিয়ে এখন নানা আলোচনা চলছে বরগুনা জেলাজুড়ে। মিন্নি ন্যায়বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা রয়েছে দেশের অনেক সাধারণ মানুষের মাঝেও।
গত বছর ২৬ জুন বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। ওই ঘটনার একটি রোমহর্ষক ভিডিও ক্লিপ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
সেই ভিডিওতে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তার স্ত্রী মিন্নি স্বামীকে বাঁচাতে হামলাকারীদের নির্বৃত্ত করার চেষ্টা করছেন। ওই ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় মিন্নিকে এক নম্বর সাক্ষী করা হয়। রিফাত হত্যার পর বরগুনা শহরে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ দৌরাত্ম্যের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
তাদের নেপথ্যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে রিফাত হত্যার কারণ নিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে গত বছর ২ জুলাই মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
এর পরপরই মিন্নির শ্বশুর হত্যাকাণ্ডে তার পুত্রবধূ মিন্নির জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে আলোচনা নতুন মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সেদিন রাতে তাকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। কিন্তু মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী সেদিন আদালতে দাঁড়াননি। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের নির্দেশনার কারণে কোনো আইনজীবী মিন্নির পক্ষে সেদিন আদালতে ছিলেন না বলে অভিযোগ ওঠে। আর পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিন্নি বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর তখন অভিযোগ করেন, নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তিনি দাবি করেন। পরে ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে। তবে শর্ত দেওয়া হয়, জামিনে থাকা অবস্থায় তিনি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন। আর এ সময়ে মিন্নি গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না।
হত্যাকাণ্ডের দুই মাসের মাথায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবির বরগুনার আদালতে মিন্নিসহ ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এজাহারের এক নম্বর আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তার নাম অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি।
রায় ঘোষণার আগে মঙ্গলবার মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় আমরা শুরু থেকেই বলেছি মিন্নি নির্দোষ। তার স্বামী রিফাত শরীফ তার বাবার কাছে মৃত্যুর আগে যে জবানবন্দি দিয়েছে তাতে এমন কিছু কথা বলে গেছে যাতে মিন্নি এ মামলায় একমাত্র সাক্ষী। রিফাত মৃত্যুর আগেও বলেছে, মিন্নি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে আসামি করেছে।
এ আইনজীবী আরও বলেন, আমরা মিন্নিকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য সব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছি। আমরা আশা করি, মিন্নি এ মামলা থেকে অব্যাহতি পাবে। তারপর আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা আমরা মেনে নেব। আর মিন্নিকে অভিযুক্ত করে আদালত রায় দিলে অন্য আসামিদের সঙ্গে তাকেও জেলহাজতে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে মিন্নির আপিল করা সুযোগ থাকবে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম মজিবুল হক কিসলু বলেন, এ মামলায় আটজন আসামি ১৬৪ ধারায় হত্যাকা-ে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। মিন্নি নিজেও রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা বলে জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া মোবাইল রেকর্ড ও মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিবাহ ও গোপন সম্পর্কের বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে। এ মামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী মিন্নি। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আশাবাদী আদালত এ মামলায় মিন্নিকে অভিযুক্ত করে রায় প্রদান করবে।