বিশ্বব্যাপী চলছে এক ক্ষুদ্র অনুজীব করোনাভাইরাসের তাণ্ডবলীলা। এ পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে বত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রাণ হারিয়েছে দুই লক্ষাধিক মানুষ । বাংলাদেশেও আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ১ শ’ ৩ জন। প্রাণ হারিয়েছেন ১শ’ ৬২ জন।
বিশ্বের মানুষ জীবন বাঁচাতে আজ অবরুদ্ধ হয়ে ঘরে বসে আছে । ফলে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে । আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আভাস দিয়েছে মহামন্দার। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ । এই কঠিন সময় মোকাবিলা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন কৃষিপণ্য রক্ষা করার এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন কোন জমি অনাবাদি না রাখার জন্য। এই নির্দেশনা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলতে হবে এবং অতীব জরুরী প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। আবার মানুষ ঘরের বাইরে যেতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হবে। দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে পড়বে, দেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে, দেশের মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাবে। যা মোটেও কাম্য নয়। তাহলে মানুষ কোনটি বেছে নেবে, অনুজীবের হাতে মৃত্যু নাকি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ । এ এক ভীষণ দ্বিধা। আজ মানব জীবনের সামনে বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক তৈরি করার জন্য। ইতিমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাধীন প্রতিষেধকটি মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। এই প্রতিষেধকের পরীক্ষা সফল হলেও তা সাধারণ পর্যায়ে পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। সেই পর্যন্ত ঘরে বসে থাকলে হয়ত সচল অর্থনীতি বিকল হতে বাধ্য।
এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে সবার একটাই প্রশ্ন ঘরে বসে জীবন বাঁচাবে? নাকি জীবন বাঁচাতে জীবিকার পথে নেমে পরবে? জীবন বেঁচে থাকে জীবিকার মাধ্যমে। তাই অদম্য মানুষ যুগ যুগ ধরে শত প্রতিকূলতার মাঝেও জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছে জীবিকা অর্জনের পথে। জীবন ও জীবিকা একে অপরের সহায়ক, বয়ে চলে সমান্তরালভাবে। আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিন জর্জিভা তার বক্তব্যে বলেছেন জীবন ও জীবিকা একে অপরের হাত ধরে চলে।
আমাদের দেশের দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের খাদ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করার মতো সক্ষমতা অনেক কম। তাদের জন্য একই সাথে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন কাজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বেশ কিছু বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এই পরিস্থিতি উত্তোরনের জন্য সহায়ক। এ রকম মহামারীর সময়ে সবকিছু সরকারের একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এইরুপ পরিস্থিতিতে সমাজের বিত্তবানদের সমন্বয়ে, সরকারি সিদ্ধান্তের সাথে সমন্বয় করে এলাকাভিত্তিক সেল গঠন করে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত বন্দোপাধ্যায় বলেছেন,‘লকডাউন শুধু ভাইরাসের বিস্তারকে ধীরগতি করতে পারে।” লকডাউনের মাধ্যমে যেমন ভাইরাস এর বিস্তার এর গতি ধীর হচ্ছে তেমন আমাদের অর্থনীতিও ধীরে ধীরে অচল হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে । এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে । উৎপাদন কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে এবং মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান অবনমিত হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে ঋনাত্মক প্রভাব পড়বে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন যা অর্থনীতির উপর ঋনাত্মক প্রভাব প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
উৎপাদন ও যোগান ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে স্বাস্থ্যখাতে আরও প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে, আরও অধিক পরিমাণে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের দ্রুত আলাদা করে পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। বাকিদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মানতে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মানতে বাধ্য করা। কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দুরত্ব কঠোরভাবে নিশ্চত করা। শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যাতে কোন আক্রান্ত শ্রমিক থেকে অন্য কেউ আক্রান্ত হতে না পারে।
এই বিষয়গুলো সরকারের একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক, বেসরকারি পর্যায়ে অত্যন্ত দক্ষতা, আন্তরিকতা, সততা, নিষ্ঠার সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেতে একটি সামগ্রিক প্রচেষ্টায় শুধু সফলতা এনে দিতে পারে। সফলতার ভাগীদার যেমন সবাই তেমনি কারও ভুল বা গাফিলতির কারনে দুর্ভোগও হবে সবার। মনে রাখতে হবে এখানে ভুল বা গাফিলতির কোন সুযোগ নেই।
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লষণ করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল বা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। তাহলে জীবন ও জীবিকা উভয়ই নিরাপদ থাকবে।
লেখক: ব্যাংক কর্মী
ই-মেইল: pranabpaul30ju@gmail.com