1. admin@banglabahon.com : Md Sohel Reza :
একজন ব্যতিক্রমী কূটনীতিক
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন

একজন ব্যতিক্রমী কূটনীতিক

কূটনীতি ডেস্ক
  • প্রকাশ: রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১

বিক্ষোভে ফুটছে মিয়ানমার। রাজপথ তাজা রক্তে সিক্ত হচ্ছে। বন্দুকের গুলি, সেনাদের বুঁটের আঘাত। কোনোকিছুই আধুনিক সময়ের গণতন্ত্রকামী মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে সামরিক জান্তার হাত। মিয়ানমার যখন বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দেশটির এক কূটনীতিক। তিনি জাতিসংঘে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে কয়েকদিন ধরে তিনি আলোচনায়।তিনি হলেন অং সান সুচির বেসামরিক সরকার নিযুক্ত জাতিসংঘে মিয়ানমারের কূটনীতিক বা দূত কাইওয়া মোয়ে তুন। তিনি যখন আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে জাতিসংঘে বক্তব্য রাখছিলেন তখন তার কণ্ঠ কাঁপছিল। কখনো উচ্চকিত হচ্ছিল কণ্ঠ। কখনো সুর নেমে যাচ্ছিল। তিনি জোরালো কণ্ঠে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাইওয়া মোয়ে তুন বলেছেন, জনগণের সরকার, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের জন্য সরকারের পক্ষে আমরা লড়াই অব্যাহত রাখবো।
অভ্যুত্থানের পর স্যুট-টাই পরিহিত ৫১ বছর বয়সী কাইওয়া মোয়ে তুন জাতিসংঘে হাত তুলে তিন আঙ্গুল দেখিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে গণআন্দোলনের প্রতি তিনি সমর্থন প্রকাশ করেছেন। এ সময় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এটা ছিল ২৬ শে ফেব্রুয়ারি। এদিন রাতে তিনি যখন বাসায় ফিরেছেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে ঘিরে ধরেছেন। তাদেরকে তিনি আগেই বলেননি তার পরিকল্পনা কি। তার ১২ বছর বয়সী মেয়ে কাছে গিয়ে বললো- বাবা, তুমি তিন আঙ্গুল তুলে যে স্যালুট দেখিয়েছো তা ঠিকমতো করতে পারো নি। তোমার আঙ্গুলগুলো ফাঁকা না রেখে একসঙ্গে রাখা উচিত ছিল। কাইওয়া মোয়ে তুন মেয়ের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, তাকে নিয়ে তার কন্যা গর্ববোধ করে। তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম এখন জানে গণতন্ত্র কি। আমিও গণতন্ত্র সম্পর্কে জানি। তাই আমি কতটা মর্মাহত হয়েছি সেটা প্রদর্শনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। বর্তমান পৃথিবীতে সামরিক অভ্যুত্থান অগ্রহণযোগ্য।
১লা ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, প্রায় এক দশকের গণতান্ত্রিক চর্চাকে দু’পায়ে পিষে গণতন্ত্রের ওপর হাত রাখে, তখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেনি যে, এত তীব্র হবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। যে সমাজে কূটনীতিক, শিক্ষক, ডাক্তার, রেল শ্রমিক, ব্যাংক টেলার, পাওয়ার স্টেশন এবং পুলিশ অফিসার আছে- তারা এসব মেনে নিতে পারেন না। তরুণদের পাশাপাশি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষে প্রতিদিন মিয়ানমারের রাস্তা ভরে যাচ্ছে। তাদের বুলেট বা খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তারের ভয় নেই। জানে যেকোনো সময় সেনাদের গুলিতে নিথর হয়ে পড়তে পারে রাস্তায়। তা সত্ত্বেও রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে সব সময়। চলছে গণ অসহযোগ আন্দোলন। এটা পরিচিতি পেয়েছে সিডিএম হিসেবে। দেশের বেশির ভাগ কার্যক্রম বন্ধ। বন্ধ হয়ে আছে সব। বন্ধ ব্যাংক। সরকারি ক্লিনিকগুলো ফাঁকা। ডাক্তার নেই। নার্স নেই। অনেক রেল লাইন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু দেশের বাইরে মিয়ানমারের দূতাবাসগুলোতে ভিন্ন চিত্র। তারা সিদ্ধান্ত নিতে প্রচ- হোঁচট খাচ্ছে। তারা কি জনগণের কাতারে দাঁড়াবে নাকি সামরিক জান্তার পাশে দাঁড়াবে। এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দূতাবাসগুলো নিজেদের সঙ্গে নিজেরাই এক রকম সংগ্রাম করছে। এর মধ্যে কাইওয়া মোয়ে তুন সাহস দেখিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে, আমি কি করবো সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি প্রতিবাদ করবো। কখনোই সামরিক শাসকদের মেনে নেবো না।
কাইওয়া মোয়ে তুন বিদ্রোহী হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তৎকালীন সেনাপ্রধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজতান্ত্রিক একটি দলের হয়ে কাজ করতেন তার পিতা। ওই সেনাপ্রধান ১৯৬২ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। এর পরই মিয়ানমারে শুরু হয় সামরিক যুগ। আষ্টেপৃষ্ঠে মিয়ানমারকে একপেশে করে রাখে সেনারা। ১৯৮৮ সালে যখন ইউনিভার্সিটি অব ইয়াঙ্গুনের শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের পক্ষে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, তখন মিয়ানমারের এই শহরের রাস্তায় একপাশে অবস্থান করছিলেন কাইওয়া মোয়ে তুন। তিনি বলেন, খোলামনে বলছি, আমি ওই বিক্ষোভে অংশ নিই নি। আমার পিতামাতা চেয়েছিলেন আমি বাসায় থাকি।
কাইওয়া মোয়ে তুনের একজন সহপাঠী ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের কো কো গাই। ১৯৮৮ সালে ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। সেনাবাহিনী তাদের বিক্ষোভের ওপর চড়াও হয়। কো কো গাই’কে দেয়া হয় জেল। তিনি ১৭ বছর জেল খেটেছেন। কো কো গাই এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সিডিএম আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ইউ কাইওয়া মোয়ে তুন যোগ দিয়েছে এ জন্য আমি বিস্মিত ও গর্বিত। ১৯৮৮ সালের ওই বিক্ষোভ রক্তপাতের মাধ্যমে দমন করে সামরিক জান্তা। এরপর জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়।
কাইওয়া মোয়ে তুন ছিলেন একজন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার কোনো ডিগ্রি ছিল না। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করেন। কিন্তু এর মধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে ইরাবতী নদী দিয়ে। লাখ লাখ মিয়ানমারের নাগরিকের মতো অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পালিয়ে যান কাইওয়া মোয়ে তুন। মালয়েশিয়াতে তিনি রেফ্রিজারেটর তৈরি এবং বিভিন্ন রকম পেইন্টের কাজ করতে থাকেন। এরপর সিঙ্গাপুরে একজন শিপ ক্রু হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বিদেশ সফর তার কাছে ছিল বিস্ময়কর। তিনি প্রথমে ব্যাংকক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে চমৎকার খোলা বাতাস অনুভব করেন। টেলিভিশনে কোনো বিষোদগার নেই। সর্বত্রই আলোর বন্যা। যেন আলোর উৎসব। এর তুলনায় ইয়াঙ্গুন এক অন্ধকারময় শহর। সন্ধ্যার পরই অন্ধকার নেমে আছে। বাতাসের গুণগত মানও ভাল না।
১৯৯১ সালে আবার স্কুল খুলে দেয়া হয়। এবার দেশে ফিরে আসেন কাইওয়া মোয়ে তুন। তিনি বলেন, এ সময় এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের চেয়ে তার নিজের দেশ কত পিছিয়ে আছে তা তিনি তার মা-বাবাকে বলতেন। মানবাধিকারের রেকর্ডের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়া আরো অনেক প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। এর ফলে মিয়ানমার পিছিয়ে আছে। কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন কাইওয়া মোয়ে তুন। যোগ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তখনও তার সহপাঠীদের অনেকে রাজনৈতিক বন্দি। তিনি জাকার্তায় থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাকে কাজ দেয়া হয় নিউ ইয়র্কে এবং সিঙ্গাপুরে।
২৭ শে ফেব্রুয়ারি তিনি ১৯৩ জাতির জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। অভ্যুত্থানকে বানচাল করে দিতে প্রয়োজনীয় যেকোনো উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। ফলে তাকে বরখাস্ত করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না কাইওয়া মোয়ে তুনের। তাকে বরখাস্ত করণকে প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছেন কাইওয়া মোয়ে তুন। তিনি বলেছেন, আমি একজন সরকারি কর্মচারী। আমি সরকারের পক্ষ থেকে আসা নির্দেশনা মতো চলবো। সেনাবাহিনী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তাই এখনই উত্তম সময়, আমাদের প্রকৃত রূপ প্রকাশের। আমাদের বাস্তব প্রত্যাশা প্রকাশ করার। এটা মিয়ানমারের জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব। (বার্তা সংস্থা রয়টার্স অবলম্বনে)

সূত্র: মানবজমিন

শেয়ার করতে চাইলে...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ...
© বাংলা বাহন সকল অধিকার সংরক্ষিত ২০১৯-২০২৪।
ডিজাইন ও আইটি সাপোর্ট: বাংলা বাহন
error: Content is protected !!