নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অসদাচরণের অভিযোগে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার জাফরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন কবিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রবিবার সকালে তাকে স্থায়ীভাবে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। এরপর তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থী, অভিভাবক এসব অভিযোগ তুলে প্রধান শিক্ষকের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়ে এসে প্রধান শিক্ষককে ১৫ দিনের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করেন।
এরপর থেকে প্রধান শিক্ষকের দোসর ও ভাড়াটিয়া লোকজন তাকে স্বপদে বহাল করতে এলাকায় অপতৎপরতা শুরু করে দেয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ এসব দাবি সমর্থনকারীদেরও নানাভাবে নাজেহাল করার হুমকি-দামকি, চাপ সৃষ্টি ও আর্থিক সুবিধায় ম্যানেজ করার পায়তারা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভূক্তভোগিরা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, সকাল নয়টার দিকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে প্রধান শিক্ষকের স্থায়ীভাবে অপসারণ ও তার দালালদের হুশিয়ারি সাবধানসহ নানা স্লোগানে শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি জাফরগঞ্জ-উথলি আঞ্চলিক সড়কের ধূসর মোড়ে এসে মানববন্ধন মিলিত হয়। মানববন্ধনে এলাকার নানা শ্রেণি পেশার শ’ শ’ লোকজন একাত্মতা ঘোষণা করে যোগ দেন।
মানববন্ধনকালে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা, অসদাচরণ, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্নসাতের উল্লেখযোগ্য খাতগুলো নিয়ে অভিযোগ করে বলেন,‘ করোনাকালীন সময়ে বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বিদ্যুৎ বিল আদায় করেছেন। এখনও তা বহাল রয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে সেশন ফি পাঁচশ টাকা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ থাকলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে এক হাজার । ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির ফরম একশ’ টাকা করে বিক্রি করেছেন। বিদ্যালয়ে জমি ক্রয়ে লাখ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয়ের টাকা দিয়ে নিজের স্ত্রীর নামে ও তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল করিম শেখের নামে জমি কিনেছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাতায়াত ভাতা দুই হাজার টাকা ব্যয় দেখানোয় তৎকালীন সভাপতি প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিস দিলে জবার দেননি। অবৈধভাবে এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নম্বরপত্র, সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিটিতে দুইশ’ থেকে তিনশ টাকা নিয়ে দেননি রশিদ। প্রধান শিক্ষক প্রতি মাসে মোবাইল ভাতা পনেরশ’ টাকা ও ঝুকি ভাতা দুই হাজার টাকা নেন। প্রধান শিক্ষক ঢাকায় যাতায়াতে প্রতিবার পনেরশ’ টাকা, মানিকগঞ্জে পাঁচশ’ টাকা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে দুইশ’ টাকা নেন। তাছাড়া, অফিস খরচেও অতিরিক্ত টাকা নেন।
নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি ২৯৬ টাকার স্থলে ৪৩০ টাকা আদায় করা হয়েছে। চলতি বছরের আগস্টের আগে অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা ফি ৫৫০ টাকা আদায় করা হয়। অথচ পরীক্ষার ফি নেয়ার কথা ছিল চারশ’ টাকা। ৫৫০ টাকা পরীক্ষা ফি আদায় করেও প্রবেশপত্র ফি বাবদ আরও ১০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। কিন্তু সেই সময় সরকার পতন আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা বন্ধ থাকে। পুনরায় বার্ষিক পরীক্ষায় ৫৫০ টাকা দাবি করলে শিক্ষার্থীরা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে কক্ষ থেকে বের করে দেন। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন বছর শুরুতে শিক্ষার্থী প্রতি পাঁচশ’ টাকা আদায় করা হয়। উপ-বৃত্তি ফরমের নামে ষষ্ট শ্রেণির প্রায় দুইশ’ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দুইশ’ টাকা করে আদায় করা হয়। বছরের শুরুতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সেশন ফি আদায় করা হয়। যারা দিতে ব্যর্থ হয়, তাদের বই দেয়া হয় না।
প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে কর্মচারি নিয়োগেও স্বজনপ্রীতি ও লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান সহকারী শিক্ষক আব্দুল মজিদ ও অফিস সহকারী শফিকুল ইসলাম প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির সহযোগী এবং সুবিধাভোগী। ২০২৪ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে সংবর্ধনায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এভাবে আরও অনেক খাত থেকে ভূয়া ভাউচারে লাখ লাখ টাকা আত্নসাৎ করেছেন প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে ভাউচারসহ তদন্ত করলেই প্রধান শিক্ষকের সব অপকর্ম বের হয়ে আসবে বলেও জানান শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী আবারও নানা স্লোগানে বিক্ষোভ মিছিল বের করে জাফরগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ করে বিদ্যালয়ে এসে শেষ করেন। এ সময় নানা শ্রেণি পেশার মানুষ বিদ্যালয়ে উপস্থিত শিক্ষকদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথা বলেন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য হলে প্রবেশ করে।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আরশেদ আলীর কক্ষে আসেন তেওতা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হারুণ। তিনি প্রধান শিক্ষকের পক্ষে সবার উদ্দেশ্য বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে আর না এগিয়ে এলাকার মুরুব্বি নিয়ে আমরা বসি। প্রধান শিক্ষক যদি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। তাহলে তার পদে বসবে। আর যদি না চায়, তাহলে প্রশাসন যা ব্যবস্থা নেয়ার নেবে।’
একথা শুনে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তারা কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। ‘আলমগীরের দালাল‘ এসেছে বলে বলাবলি করতে থাকে।
এ ব্যাপারে তেওতা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলম হারুণের কাছে ফোনে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি একটি মিটিংয়ে আছি। পরে ফোন দেন।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা গত বৃহস্পতিবারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন,‘ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় এই হারুণ ও তার মেঝো ভাই আকতার হোসেন আনন্দ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষককে ১৫ দিনের সাময়িক বরখাস্ত করে চলে যান। এরপর ওই হারুণের মোটরসাইকেল পেছনে বসে প্রধান শিক্ষক আলমগীরের বড় ভাই হাবিব চলে যান। এরপর থেকেই তারা প্রধান শিক্ষকের পক্ষে কাজ করছেন বলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর সন্দেহ স্পষ্ট হয়েছে।’
আরও পড়ুন…
শিবালয়ে প্রধান শিক্ষকের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সাময়িক বরখাস্ত