মানিকগঞ্জের শিবালয় সদর উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. বাসুদেব দে শিকদারকে দুর্নীতির দায় নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারিরা।
অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মাসাত করায় ১৭ মাসের বেতন বকেয়া পড়ে থাকায় আজ (শনিবার) দুপুরে তাকে অধ্যক্ষের কক্ষে এই আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কলেজে পাঠদান ও পরীক্ষা বন্ধ রেখে মানববন্ধন ও আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে।
এর আগে ১২ই মে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এডহক কমিটির সভাপতি মো. জাকির হোসেনের কাছে লিখিতভাবে ওই অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করেছেন শিক্ষক ও কর্মচারিরা। এডহক কমিটির সভা ডেকে বিধি মোতাবেক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন সভাপতি।
স্থানীয়রা ও কলেজ সংশ্লিরা জানান, ১৯৯২ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর এমপিওভূক্ত করা হয় ১৯৯৮ সালে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার অবসরে যান। আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও তদবিরে ওই পদে নিয়োগ পান ড. বাসুদেব দে শিকদার। তাঁর নিয়োগেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত ও মামলা হলেও দলীয় প্রভাবে স্বপদে বহাল রয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে একেক সময় একেকজনকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যসহ উল্লেখযোগ্য পদে বিনাভোটে বসিয়েছেন এই অধ্যক্ষ।
প্রত্যেক শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে। তিনি ভূয়া খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়েও কলেজ থেকে বেতন হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। কলেজে ভাউচারে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কাঁচা ভাউচারে উন্নয়ন প্রকল্পে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়টিও নিরিক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মৌখিকভাবে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাড়িতে নিজের ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। কলেজের ফান্ড থেকে দিয়েছেন শিক্ষকের বেতন।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গভর্নিং বড়ি সভাপতি ও সদস্যদের সঙ্গে দ্বন্ধে জড়িয়েছেনও তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার তদন্ত হয়েছে। কলেজের অভ্যন্তরীণ নিরিক্ষা, অধিদপ্তরের নিরিক্ষা ও তদন্তে প্রতিবেদনে এই অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণ মিলেছে।
কিন্তু, প্রতিবারেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব বিস্তার, ম্যানেজ ও নিয়ম বর্হিভূত গভর্নিং বডির রেজুলেশনের মাধ্যমে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। তিনি সব সময়ই কলেজের আয়-ব্যয়ের ভাউচার ও উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ ও নিরিক্ষা প্রতিবেদন গোপন রাখেন। কোনভাবেই প্রকাশ করেন না। তথ্য চেয়েও পাওয়া যায় না।
শিক্ষক-কর্মচারিরা অভিযোগ করে জানান, কলেজে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। কলেজের পর্যাপ্ত আয়ও রয়েছে। কিন্তু, ৫ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে তাদের এ পর্যন্ত ১৭ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। তাদের মধ্যে এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারি ছাড়াও অন্তত ১৬ শিক্ষক-কর্মচারি রয়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতন জীবন কাটাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই বেতন বকেয়া থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গত বছরের ১৫ই নভেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তারা।
এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এডহক কমিটির সভায় গত ২৩ শে জানুয়ারি কলেজের দুই বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব তদারকির জন্য উপজেলা অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার রাশেদ আল মাহমুদকে প্রধান করে সাত সদস্যের অডিট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি অডিট রিপোর্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এডহক কমিটির সভাপতি মো. জাকির হোসেনের কাছে জমা দিয়েছেন। তিনি এখন পর্যন্ত এডহক কমিটির সভা ডেকে অধ্যক্ষ ড. বাসুদেব দে শিকদারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তবে, অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা না হলেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, শুধু দুই বছরেই অধ্যক্ষের কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ টাকা লাখ টাকা লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে।
শিক্ষক-কর্মচারিরা ও স্থানীয় লোকজন আরও অভিযোগ করে জানান, অধ্যক্ষ ড. বাসুদেব দে শিকদার আওয়ামীলীগের দোসর। দলীয় প্রভাবেই কলেজে পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কলেজেও তাঁর দোসর হিসেবে রয়েছেন তিনজন শিক্ষক। তাদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামীলীগের দুই উপদেষ্টা সদস্য ড. উত্তম কুমার সরকার ও মো. জানে আলম ছিদ্দিকী ওরফে বুলবুল আহমেদ। অপরজন প্রভাষক মো. আফতার শিকদার। কলেজে অধ্যক্ষের সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির সহযোগি ও সমর্থক তাঁরা।
এ কারণে তারা বেতন বকেয়া থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেননি। এরপর অপসারণ দাবিতে এডহক কমিটির সভাপতি কাছে লিখিত অভিযোগপত্রেও স্বাক্ষর করেননি। তারা অধ্যক্ষকে রক্ষায় নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক-কর্মচারিরা জানান, কলেজে অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে মানিকগঞ্জে শহরে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এলাকায় কৃষি জমি ও পুকুর করেছেন। বিলাসি জীবন-যাপন করেন। আর কলেজের শিক্ষক-কর্মচারিদের ১৭ মাসের বেতন বকেয়া রেখেছেন। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে এমনিতেই মানবেতন দিন কাটছে। সামনে ঈদ, কিভাবে উদযাপন করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাদের।
এ কারণে শনিবার দুপুরে অধ্যক্ষের কক্ষে শিক্ষক-কর্মচারিরা দুর্নীতির দায় নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেধে দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগপত্র এডহক কমিটির সভাপতির কাছে না দিলে অপসারণ দাবিতে রবিবার দুপুরে মানববন্ধন করা হবে। কলেজে পাঠদান ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হবে। সেখানে থেকে পরবর্তি আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে শিবালয় সদর উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. বাসুদেব দে শিকদারের ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও গভর্নিং বডির এডহক কমিটির সভাপতি মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘অধ্যক্ষের অপসারণের অভিযোগপত্র হাতে পেয়েছি ১৮ই মে। আর অডিট রিপোর্টও পেয়েছি। রিপোর্টে কি আছে এখনো দেখা হয়নি। এডহক কমিটি সভা ডেকে রিপোর্টে যদি কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি থাকে, তাহলে বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’